ভারতের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে মুঘল আমলে নির্মিত তাজমহলের মত এমন নিদর্শন দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া যাবেনা। সম্রাজ্ঞী মমতাজের সৃতির প্রতি গভীর ভালবাসা জানাতে সম্রাট শাহ জাহান তাজ মহল নির্মাণ করেন। সেই অনন্য কির্তী তাজ মহল বিশ্ব বাসির কাছে এক অপার বিস্বয়ের নাম। ১৬২৮ সালে মোঘলা শাসনের দায়িত্ব গ্রহন করেন সম্রাট শাহ জাহান। আর তাজ মহলের নির্মাণ কাজ শুরু করেন ১৬৩২ সালে। তাজমহল নির্মান করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর লেগেছিলো। ১৬৬৬ সালে তার মৃত্যুর পর তাকেও মমতাজের পাশে সমাহিত করা হয়।
তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। তাজ মহলের নকশা করা হয়েছে মোঘল পূর্ব পুরুষদের দ্বারা নির্মিত বিখ্যাত সব মহল থেকে। সম্রাট নিজেই তাজ মহলের নকশা অঙ্কন করেন। তাজ মহলের চার পাশের চারটি মিনার সংগ্রহ করা হয়েছে তান পিতার সমাধী থেকে। এভাবে প্রতি পিতামহ, পিতামহের সমাধী থেকে তাজ মহলের এক একটি অংশ জুড়ে সম্রাট শাহ জাহান নিজেই তাজ মহলের নকশা করেন। মোঘল আমলে বেশিরভাগ দালান তৈরি করা হতো লাল বালি আর পাথর দিয়ে। কিন্তু তাজ মহল নির্মানে শাহ জাহান প্রথম শ্বেত পাথর ব্যবহার করেন। শ্বেত পাথরের সৌধ হিসেবে বিশ্বব্যপি তাজ মহলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যমুনা তীরবর্তি তাজ মহল নির্মানের জমিটি ছিলো খুবই নিচু। জায়গাটি তাজ মহল নির্মানের উপযুক্ত করতে প্রচুর মাটি ফেলা হয়। তাজ মহলটি যমুনা নদীর উচ্চতা থেকে ১৬০ ফুট উঁচু করা হয়।
আরও পড়ুনঃ ইহুদীরা আল-আকসা কেন ভাঙতে চায়?
তাজ মহল নির্মান করার জন্য ২২ হাজার মানুষ নিযুক্ত করা হয়েছিলো। যাদের মধ্যে ছিলো, নির্মান শ্রমিক, পাথর কাটা শ্রমিক, চিত্র শিল্পী, সূচিকর্ম শিল্পী এবং ক্যালিগ্রাফার। তাজ মহলের নির্মান সামগ্রী বহনের জন্য ১ হাজার হাতি ব্যবহার করা হয়েছে। তাজ মহলের জন্য শ্বেত পাথর আনা হয়েছিলো রাজস্থান থেকে। শ্বেত পাথরে বসানো ও নকশা করানোর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৮ ধরনের দামী পাথর আনা হয়। পাঞ্জাব থেকে আন্না, চিন থেকে স্ফটিক, তিব্বত-আফগানিস্থান এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আনা হয় নীলকান্ত মণী। তাজ মহলের অসাধারন নির্মান সম্পন্ন করতে ভারতী বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে স্থাপত্য ব্বিশেষজ্ঞদের আগ্রায় আনা হয়। তাজ মহলের ভাষ্কররা আসেন বুখারা থেকে, হস্থাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া ও পারশ্য থেকে, রত্ন শিল্পীরা উত্তর ভারত থেকে এবং মণীকারেরা আসেন বেলুচিস্থান থেকে।
তাজ মহল অত্যন্ত শক্ত ভীতের উপর নির্মান করা হয়েছে। অনেকগুলু পাত কুয়া খুড়ে এই ভীত তৈরি করা হয়েছে। পাতকুয়া গুলুর উপর বিশাল ভিত্তি স্থাপন করে তার উপর মূল সৌধ বসানো হয়েছে। আর সে কারনে বড় ধরনের ভূমিকম্পেও তাজ মহল সহজে ক্ষতি হবে না। বর্তমানে অনেক স্থাপত্য নির্মানেও এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। তাজ মহলের মূল সৌধের চার ধারে প্রায় ১৩০ ফুট উঁচু চারটি মিনার রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় চারটি মিনার যাতে মূল সমাধীর উপর ভেঙে না পরে সে জন্য মিনার গুলুকে সামান্য বাইরের দিকে কাথ করে নির্মান করা হয়েছে। তাজ মহলে কোন লোহার কাঠামো ব্যবহার হয়নি সম্পূর্ণ পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সৌধ।
তাজ মহলের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ হলো এর মাথার উপরের গম্বুজ। এতেও কোন লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হয় নি। ছোট ছোট পাথর জোড়া দিয়ে বিশাল এই গম্বুজ তৈরি করা হয়। টানা ১৭ বছর নির্মান কাজ চলার পর ১৬৪৮ সালে এই সৌধের প্রাথমিক নির্মান কাজ শেষ হয়। নির্মান কাজ শেষ হওয়ার পর এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করা হয়। তাজ মহলের আশেপাশের কাজু বাগান ও তিন দিকে তিনটি প্রবেশদ্বার সহ আরও পাচ বছর সময় লাগে। তাজ মহলের আরও একটি অবাক করার মত বিষয় হলো এর সামনের দিকের প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার সময় মনে হবে তাজ মহল দূরে সরে যাচ্ছে, আর বের হয়ে আসার সময় মনে হবে তাজ মহল যেনো আরও কাছে আসতে শুরু করেছে।
তাজ মহলের ভেতরে ও বাইরে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি আছে। মমতাজের সমাধীর পাশে তার পরিচিতি ও প্রশংসামূলক ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়। সমাধীর পাশের দেয়ালে রয়েছে আল্লাহর ৯৯ নামের ক্যালিগ্রাফি। তবে তাজ মহলের আসল সৌন্দর্য হলো এর প্রবেশদ্বারের অসাধারন ক্যালিগ্রাফি। এসব ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত অঙ্কিত রয়েছে। আব্দুল হক নামের এক ব্যাক্তি এসব ক্যালিগ্রাফির স্রষ্ঠা। সম্রাট শাহ জাহান তার কাজে খুশি হয় তার নাম রাখেন 'আমানত খান'। তাজ মহলের উচ্চতা ২৪০ ফুট যা দিল্লির কুতুব মিনারের সমান।
দিনের বিভিন্ন সময়ে আলোর সাথে তাজ মহলও বিভিন্ন রঙ ধারন করে। সকালে গোলাপী বর্ণের, দুপুরে হালকা হলুদ বিকালে দুধের মত সাদা এবং চাদের আলোতে সোনালী বর্ন ধারন করে পৃথিবীর এই আশ্চর্য স্থাপনা। গবষকদের মতে, দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রঙ ধারন করার পেছনে তাজ মহলের নির্মান শৈলী ও এতে ব্যবহার করা শ্বেত বড় ভূমিকা রাখে। তাজ মহলে কোন বাতি জ্বালানো হয় না। বাতি না জ্বালানোর একটা বিশেষ কারন রয়েছে। তাজ মহল শ্বেত পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় আর শ্বেত বা সাদা রঙ থেকে আলো বেশি প্রতিফলিত হয়। আর এই আলোর প্রতিফলন রাতে পোকা-মাকড়দের অনেক বেশি আকর্ষন করে।
যে যমুনা নদী তাজমহলের অবস্থানকে মহিমান্বিত করেছিলো যে নদী আজ মৃত প্রায়। তাজ মহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা ভারতের অন্যতম দূষিত নদী। যমুনা তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারানো কারনে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তাজ মহলের ভিতেরও বেশ ক্ষতি হচ্ছে। যমুনা তীরবর্তী বিভিন্ন তেলের কারখানার জন্য এই এলাকার বাতাসও অন্যন্ত দূষিত। বায়ু দূষনের কারনে তাজ মহলের প্রকৃত রঙ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তাজ মহলের আশে পাশে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। কারন গাড়ি থেকে নির্গত ধোয়া তাজ মহলের ক্ষতি করতে পারে।
তাজ মহল ও শাহ জাহান সম্পর্কে অতি রঞ্জিত একটি ভ্রান্ত ধারন হলো তাজ মহল যারা নির্মান করেছিলেন সম্রাট শাহ জাহান তাদের সবার হাত কেটে দিয়ে ছিলেন। যাতে দ্বিতীয়বার আর কেউ এমন স্থাপনা তৈরি করতে না পারে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এসব কথা কোন ভিত্তি নেই। বরং তাজ মহল নির্মান কাজে অংশ নেয়া শ্রমিকের বংশধরেরা এখনও আগ্রায় বাস করছে এবং তাদের পূর্ব পুরুষদের কাজ বংশ পরম্পরায় করে আসছে। এসব মূলত কট্টর ইসলাম বিরোধীরা তাজ মহল নির্মানের পর থেকে প্রচার করে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম রাজা-বাদশাহদের ইতিহাসকে কলঙ্কগ করে প্রচার করা। National Geography তাজ মহল নিয়ে একটা ডকোমেন্টারিতে বলা হয় শাহ জাহান নাকি নিজেকে আল্লাহর আসনে বসাতে চেয়েছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)। এগুলু কট্টর ইসলাম বিরোধীদের অপ প্রচার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন