আরাল সাগর কেনো মরুভূমিতে পরিনত হলো?

আরাল সাগর কিভাবে মরুভূমি হলো



মানুষ তার নিজের সার্থে প্রকৃতিকে কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে তার একটি বড় উদাহরন হলো আরাল সাগর। অতীতে উজবেকিস্তান ও কাজাকিস্তানের মধ্যে এক বিশাল জলশয় ছিলো যার নাম আরাল সাগর। নামে সাগর হলেও এটি ছিলো মূলত লোনা পানির হ্রদ। ১৯৬০ সালের দিকে আরাল সাগর ছিলো পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। আরাল সাগরেরগভিরতা ছিলো মাত্র ২৯ ফুট্ব সর্বোচ্চ গভীরতা ছিলো ১৩৮ ফুট। ১৯৪০ সালে আরাল সাগরের আয়তন ছিলো ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তখন আরাল সাগরে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যেত। সে কারনে এর তীরবর্তি অঞ্চলে ব্যপক মৎস শিল্প গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু এতো বিশাল হ্রদ মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মরুভূমিতে পরিনত করে।



কিভাবে আরাল সাগর মরুভূমিতে পরিনত হলো?

সাবেক সোভিয়ত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ মরুভূমির মধ্যে তুলা চাষ করতে গিয়ে আরাল সাগরকে সম্পূর্নরুপে ধ্বংস করেছে। ১৯১২ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই এই অঞ্চলে তুলার চাষ হয়। তৎকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলা শিল্পে শীর্ষে অবস্থান করছিলো। এমনিতেই এই অঞ্চলটি অনেকটা শুষ্ক অঞ্চল। তার উপর তুলা চাষ করতে অনেক পানির প্রয়োজন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মূলমন্ত্র ছিলো তুলার উৎপাদন সব সময় বাড়াতে হবে। সে কারনে এই অঞ্চলে তুলার ক্ষেতের আকার প্রায় ১২শ গুন বৃদ্ধি পেয়েছিলো। প্রথম দিকে মাত্র কয়েকশ টন তুলা উৎপাদিত হলে একসময় এখানে প্রায় নব্বই লক্ষ টন তুলা উৎপাদন করা হয়। এতো বিপুল পরিমান তুলা উৎপাদন করার জন্য মরুভূমিকে সজিব করার মত প্রচুর পরিমান পানির দরকার ছিলো। 




১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কারাকুম খাল খনন করে। কারাকুম খালের দৈর্ঘ ছিলো ১,৩৭৫ কিলোমিটার। এখনও পর্যন্ত সেটিই ছিলো পৃথিবীর দীর্ঘতম সেচ খাল। সেই খাল দিয়ে সির দরিয়া ও আমু দরিয়ার পানি কারামুক মরুভূমির উপর দিয়ে তুলা ক্ষেত গুলুতে সেচের জন্য পরিবহন করা হতো। মরুভূমির উপর দিয়ে খাল প্রবাহিত করায় সেচের প্রায় ৩০ শতাংশ পানি অপচয় হতো। খাল খনন করা ছাড়াও বহু বাধ ও জলাধার বানিয়ে আরাল সাগরে পতিত নদীর গতিপথ সম্পূর্ন পরিবর্তন করে দেয়া হয়ে ছিলো। ফলে আরাল সাগরে খুব সল্প পরিমান পানি প্রবাহিত হতো।


১৯৬০ সালে হ্রদের পানি ব্যপক হারে কমে যেতে শুরু করে। ফলে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্প বন্দরগুলু পরিত্যাক্ত হয়ে পরে। ১৯৮০  সালে আমু নদীতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বাধ দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে আরাল সাগর শুকিয়ে দুটিভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্থানীয় সরকারেরা আরও বিপুল পরিমান তুলার চাষ শুরু করে। ১৯৯৮ সালে আরাল সাগরের ৯০ শতাংশ শুকিয়ে যায়। যতটুকু পানি বাকি ছিলো তাও অতীতের বিপুল পরিমান রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত থাকার কারনে বিষাক্ত ও অতিমাত্রায় লবনাক্ত হয়ে পরে। তখন যেখানকার মাছ ও উদ্ভিত সহ সম্পূর্ন জীব বৈচিত্র বিলুপ্ত হয়ে যায়। 



২০০৩ সালে আরাল সাগরকে বাচানোর পরিবর্তে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল তুলে আরাল সাগরের দুটি অংশকে স্থায়ী ভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। পরবর্তি কয়েক বছরে আরাল সাগরের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। তখন একে বলা হয় আরাল মরুভূমি। আরাল সাগর বিপর্যয়কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে ধরা হয়। ২০০৫ সালে কাজাক সরকার নদীর পানি আবারও আরাল মরুভূমিতে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করে। ফলে হ্রদের কিছুটা উন্নতি হয়। পরবর্তীতে বিশ্ব ব্যাংক আরাল সাগর রক্ষায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারে প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে আরাল সাগরে পানি ফিরে আসলেও হ্রদটি কখনও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না। তাছাড়া আরাল সাগরে পানি প্রবাহ করতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সমঝতায় না পৌছালে আরালের বাকি অঞ্চলহুলূতেও কাজ করা যাবে না। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরাল সাগর নির্ভর করে গড়ে ওঠা মানুষের কথা কখনই আমলে নেয়নি। এভাবেই প্রকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা আরাল সাগর আরাল মরুভূমিতে পরিনত হয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন