আমরা প্রতিদিন যেসব জিনিস ব্যবহার করি সেগুলু থেকে উচ্ছিষ্ট বা আবর্জনা তৈরি হয়। এসব আবর্জনার খুবই কম অংশ আমরা রিসাইকেল করে পূনরায় ব্যবহার করি, কিছু অংশ প্রকৃতিতে মিশে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ আবর্জনা প্রকৃতিতে রয়ে গিয়ে পরিবেশ দূষন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করাসহ আমাদের জীবন যাত্রায় মারাত্মকভাবে খারাপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। কিন্তু মহাকাশে যে আবর্জনা তৈরি হয় তা অপসারন করে মহাকাশ পরিচ্ছন্ন রাখার কোন উপায় নেই। এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, মহাকাশে আবার কিসের আবর্জনা তৈরি হয়?
বিশ্ব এখন সবার হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর কোন প্রান্তে কি হচ্ছে, কি ঘটছে তা আমরা ইন্টারনেট, টেলিভিশন, টেলিফোন ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম গুলু দিয়ে খুব সহজেই জানতে পারি। আর আমাদের কাছে এসব তথ্য পৌছে দেয়ার মূল কাজটি করে স্যাটেলাইট। মহাকাশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে এদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে পরেছে। কোন একটি স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে গেলে, সেটি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। এসব অকেজো স্যাটেলাইটের উপর মানুষের আর কোন নিরন্ত্রন থাকে না। ফলে এগুলু মুক্ত অবস্থায় বিপদজনক মহাকাশে প্রদক্ষিন করতে থাকে। আর এসব অকেজো স্যাটেলাইট গুলুই হচ্ছে মহাকাশের আবর্জনা। এগুলুকে বলা হয় স্পেস সাঙ্ক বা স্পেস ডেব্রিস। তবে শুধুযে স্যাটেলাইট দিয়ে স্পেস জাঙ্ক তৈরি হয় না কিন্তু নয়। মহাকাশ পর্যবেক্ষন, গ্রহ উপগ্রহ গবেষনা, এবং মহাকশ গবেষনার কাজে যেসব স্পেস প্রোভ পাঠানো, এসব থেকেও স্পেস জাঙ্ক (Space junk) তৈরি হয়।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী মহাকাশে ১ সেন্টিমিটের চেয়ে ছোট অবেজেক্ট আছে ১২ কোটি ৮০ লাখ, ১ থেকে ১০ সেন্টিমিটার আকারের অবজেক্ট রয়েছে ৯ লক্ষ এবং ১০ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় অবজেক্ট রয়েছে ৩৪ হাজার। এরা সেকেন্ডে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার বেগে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মহাকাশের লওয়ার অর্বিটে ঘুরছে। মহাকাশে থাকা এসব অকেজো স্যাটেলাইট গুলু একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষের ফলে ছোট ছোট ছোট টুকরো হয়ে বিপদ জনক ভাবে মহাকাশে ঘুরে বেরাচ্ছে। আর এ সংঘর্ষ প্রতিনিয়ত ঘটছে, যার ফলে স্পেসে ছোট অবজেক্টের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। যা ভবিষ্যৎ স্পেস মিশন ও নতুন স্যাটেলাইট স্থাপনের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি। কারন স্পেস জাঙ্ক যত ছোট হোকনা কেনো এর দ্বারা যেকোন বড় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরন হচ্ছে ১৯৮৩ সালে চ্যালেঞ্জার স্পেস সাটল, স্যাটলাইটে লাগানো রঙের মাত্র 0.2 ন্যানোমিটার টুকরো দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্পেস সাটলের জানালার কাজ ফেটে যায়। এর থেকেই বোঝা যায় মহাকাশের খুবই ক্ষুদ্র একটি কনার আঘাতে কত বড় ক্ষতি হতে পারে।
মহাকাশে বিপদজনক ভাবে এসব স্পেস জাঙ্ক মহাকাশে থাকা সক্রিয় স্যাটেলাইট ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য মারাত্মক হুমকি সরূপ। এসব স্পেস জাঙ্ক সক্রিয় স্যাটেলাইট ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সাথে প্রতিনিয়ত আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে। আমেরিকার বিমান বাহিনী ২৪ ঘন্টা স্পেসে থাকা প্রায় ২৫ হাজার স্কেস জাঙ্ক (Space junk) মনিটর করে। যখনই কোন স্পেস জাঙ্ক (Space junk) আন্তর্জাতিক মহাকশ স্টেশন বা অন্যান্য সক্রিয় স্যাটেলাইট আঘাত করার সম্ভাবনা দেয়া যায় তখন তারা মহাকাশ স্টেশন ও স্যাটলাইট গুলুর গতি পথ পাল্টে দেয়। তবে ছোট ছোট যেসব টুকরো আছে সেগুলু মনিটর করা সম্ভব হয় না। এসব ছোট ছোট টুকরোর আঘাত থেকে সাটলাইট ও মহাকাশ স্টেশন রক্ষা করার জন্য Whipple Shield নামে এক ধরনের বিশেষ সুরক্ষা আবরন দেয়া হয়।
স্পেসে থাকা এসব স্পেস জাঙ্ক (Space junk) অপসারন করা বা কমানোর কোন উপায় নেই। বরং দিন দিন স্পেস জাঙ্কের পরিমান বাড়বে। তবে উৎক্ষেপণের পরে যদি বড় আকারের স্পেস জাঙ্ক (Space junk) পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে মহাকাশে স্পেস জাঙ্ক কম তৈরি হবে। তাই বর্তমানে বিজ্ঞাপনীরা যে সব স্যাটেলাইট তৈরি করছে সেগুলুর কাজ শেষ করে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায়। সোভিয়েত ইউনিনের পাঠানো মীর স্পেস স্টেশন সফলভাবে স্পেস থেকে অপসারন করা হয়েছে। এই মহাকাশ স্টেশন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে অকেজো হওয়ার পরেও এটি বিজ্ঞানীদের নিয়ন্ত্রনে থাকে। ১৯৬৮ সালে স্পেসে পাঠানো এই মহাকাশ স্টেশন ৩৩ বছর পর ২০০১ সালে নিয়ন্ত্রিত ভাবে পেসিফিক মহাসাগরে পতিত করা হয়েছিলো।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকা সবচেয়ে বড় স্থাপনা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ১৯৯৮ সালে ২৯ নভেম্বর এই মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকেও এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলেও এটি বিজ্ঞানীদের নিয়ন্ত্রনে থাকে। মীর মহাকাশ স্টেশনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীতে এনে পেসিফিক মহাসাগরে পতিত করা হয়েহিলো ঠিক একইভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকেও পৃথিবীতে আনা হবে এবং নিয়ন্ত্রিত ভাবে স্পেসিফিক মহাসাগরে পতিত করা হবে। ২০২৪ সালে এই স্টেশনকে অবসর দেয়ার কথা থাকলেও গবেষনার সার্থে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়। এরপর ২০৩০ সালে অবসরে চলে যাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন